পুনর্মিলনী পুনশ্চ

ভারতেশ্বরী হোমসে অনুষ্ঠিত আমাদের ৩য় পুনর্মিলনী উপলক্ষে প্রকাশিত ম্যাগাজিনে বন্ধু সারিয়া মাহিমা স্বর্নার লিখা।আমাদের স্বপ্ন তখন দানা বাঁধছে।বন্ধু সারিয়া মাহিমা সেই স্বপ্ন কে বাস্তবে রূপ দিতে উদাত্ত আহবান জানান সকলকে তার এই লেখনীর মধ্য দিয়ে।উল্লেখ্য পূনর্মিলনীটি ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এটি ২০১৭তে অনুষ্ঠিত হয়।

পুনর্মিলনী পুনশ্চ

পর্ব-১
“…প্রাণের মাঝে আয়…”

অনুমান করি, “পুনর্মিলনী” শব্দটা আমার মতই আর সবার অনুভূতি-রাজ্যে একটা প্রিয় প্লাবন বয়ে নিয়ে আসে। প্রিয় নাম, প্রিয় ধাম, প্রিয় মুখ আর প্রিয় প্রিয় সব স্মৃতির বুদবুদ – উছলে উঠে উপচে পড়ে মনের এপাড় থেকে ওপাড় অবধি।

লিখতে বসে জয়াদি’র (জয়া পতি, জ্যাঠামনির কনিষ্ঠ সন্তান) কিছু কথা আজ কানে বাজছে খুব। সময়টা সম্ভবত নব্বই দশকের গোঁড়ার দিক হবে। সারি বেঁধে সবাই দাঁড়িয়ে আছি মাঠে। অফিস বারান্দার দিকে মুখ। লম্বা টানা বারান্দার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে জয়াদি’র কণ্ঠ, “ … তোমরা মনে রেখো, এটা কোন স্কুল নয়, এটা হোমস্। মানে, হোম  থেকে হোমস্। এটা তোমাদের বাড়ি। এটা তোমাদের পরিবার। একটা বিশাল একান্নবর্তী পরিবার। এখনই হয়তো পুরোটা বুঝে উঠতে পারবে না আমার কথা। কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে যাবার পর নিশ্চিত বুঝবে, হোমস্ কী …” বুঝেছি জয়াদি’। আর সকল বন্ধুরাও এমনটাই বুঝেছে ব’লে জানি।

ভাবছি তাই, এইযে আবার যাচ্ছি ফিরে ঘরে, সবে মাত্র একটা দিনে, কি করবো তখন?

কেমন আছিস? কেমন আছো? থাকছ কোথায়? করছেন কী? অমুকের কি অবস্থা রে, জানিস নাকি? তমুকের খবরটা শুনেছিস?পেশার ফিরিস্তি আর সন্তানাদির বিশদ বৃত্তান্ত … …
ডাইনিং থেকে খেয়ে বেরোতে বেরোতে হয়তো আবারও বলব, পায়েসটা মাইরি সেরকম হয়েছে। মালপোয়াটা থাকলে না একেবারে সোনায়-সোহাগা হ’ত।
থাকবে কি সেই লাবড়া-লুচি? যাচ্চলে, এটা কি পূজার মৌসুম নাকি? হচ্ছে তো পুনর্মিলনী-কথন। তবু, মা অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে ভরসা রাখি। পূজার স্মৃতির টানাহ্যাঁচড়ায় কয়েকজন হয়তো সমবেত উলুধ্বনিতে বাতাসে উড়িয়ে দেবে হাসির ডিঙা।
হোমস-এর খাবারের অতীত আর বর্তমানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে নিশ্চিত মনে পড়ে যাবে ব্রেকফাস্টের সেই “ধম্বা”-আতংক। পা’রুটির তৎকালীন প্রচলিত “ধম্বা” নামটি আজও কি চালু আছে মেয়েদের মুখে?আর মনে পড়ে যেতেও পারে, ডালে সম্ভার দেয়া শুকনা মরিচ …।
মনে আছে, সেই যে একবার ফুল চুরিতে বেদম ধরা … আর শাস্তিটাও ছিল রাজকীয়?
অ্যান্ড দ্যাট গ্রেট ডায়ালগ, “জুতো কুতো খেয়েছে আর … … “ বলব না আর, তোরা মনে কর। ওহ, মিস নেসা, মাই ফেভরিট। যমের মত ভয় পাইতাম যদিও …।

কত স্মৃতি। কত কথা। এর খোঁজ। তার খোঁজ। সাকিন-নিবাস। তর্ক-বাহাস। আলাপ-প্রলাপ।

কেউ বলবে, ইশ্, দারুণ হ’ল কিন্তু আজকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা।
অমনি আবার কেউখুলে বসবেস্মৃতির ভাণ্ডটা। আমাদের সময়ও কত জমাটি ছিল। মনে আছে, ঝর্না আক্তারের মাইকেল জ্যাকসন ড্যান্স, সেই মুন-ওয়াক! সোমা সাহাতো ক্লাস ফোরেই ফাটিয়ে দিল  এক “ইন্তি সোনা, বিন্তি সোনা” গেয়ে। “কাড়ার ঐ লৌহ কপাট” ভেঙ্গে নৃত্য-পটে রেখার শুভ আগমন? নাজুর সম্মোহনী কণ্ঠের সেই আবৃত্তি?
পিন-পতন নীরবতায় শুনেছি, “ও আলোর পথ-যাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমনা/ এ বালুচরে আশার তরনী তোমার যেন বেঁধনা …” কাঁটা-কাঁটা দিয়ে ওঠে গায়ে। কিংবা “সংকোচের বিহ্বলতায় নিজেরে অপমান/ সঙ্কটের কল্পনাতে হো’ওনা ম্রিয়মান” … শুনে বারবার অনুপ্রাণিত হয়েছি। জ্যাঠামনির জন্মদিনে “ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে” শুনেও কতই না রোমাঞ্চিত হয়েছি।

স্মৃতির স্রোতে সন্তরণ। ‘হা হা হি হি’র হর্ষ-হুল্লোড়। কল্পনা করছি, হয়তো প্রায় এভাবেই দিনটা যাবে ফুরিয়ে। ফেসবুক আইডি, ভিজিটিং কার্ড, ফোন-নম্বর আর ঠিকানা লেনদেন হবে ঠিকঠাক। আমন্ত্রণ আর নিমন্ত্রণের পালাও পরিপাটি।
শেষ বিকেলের আলোও গ’লে গ’লে গড়িয়ে যাবে। মায়াবী সন্ধ্যায় দিনমান উচ্ছ্বাসের উজান শরীরে ব’য়ে, বড় বাড়ি ছেড়ে আবার সেই ছোট ছোট বাড়ির পথে ফিরতি যাত্রা।

 

 পর্ব-২

“অগ্নির চেতনায় শান দাও”

তবু ভাবছি, আরেকটু অন্যরকমও তো হতে পারে। আর একটু খানি অন্যরকম। স্মৃতি আর প্রীতির সাথে কিছু কৃতিও যোগ হতে পারে বটে। যোগ হতে পারে কিছু নতুন মাত্রা, অর্থপূর্ণ কিছু অর্থ। অন্যরকম এক আনন্দের দ্যোতনায় এই ‘মিলনমেলা’ মেলে ধরতে পারে সম্ভাবনার এক দিগদর্শী দিগন্ত। 

জ্যাঠামনির দৃপ্ত চেতনার উষ্ণ করতলে আমরা গড়ে উঠেছি। আমাদের মননে আর মস্তিষ্কে সেই চেতনার অনুরণন। কারো চেতনা জ্বলছে দাউ দাউ অগ্নিশিখায়, কারোবা ধিকি ধিকি।চেতনারসেই অনুরণন যদি একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়, সেটা ঘটিয়ে দিতে পারে কল্যাণকর অনেক ঘটনা।

জানি কিছু, আবার জানি না এমন একাধিক ঘটনাও হরদম ঘটে যাচ্ছে – যেখানে হোমস-এর প্রাক্তন ছাত্রীরা কল্যাণী ভূমিকা রাখছে, রাখার কথা ভাবছে। আমি বলছি, ‘ঘরে’র কথা। প্রাণপ্রিয় শিক্ষাভূমি, ততোধিক প্রিয় জ্যাঠামনির কাছে আমাদের ঋণ আদৌ পরিশোধনীয় কিনা আমি জানিনা। কিন্তু হোমস-এর জন্য করবার মত অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজ আছে।

ঘটছে বা ঘটমান ছোট একটা ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করি। হোমস-এর এসএসসি-১৯৯৪ ব্যাচের প্রাক্তন ছাত্রীরা মিলে প্রায় বছরখানেক ধরে দুজন বর্তমান শিক্ষার্থীর বেতন-বাবদ খরচাদি নিয়মিত বহন করে যাচ্ছে, এবং তারা এমন আরও কিছু ছাত্রীর হোমস-এ শিক্ষাকালীন অর্থনৈতিক-দায়িত্ব নিয়মিত গ্রহণের প্রচেষ্টায় আছে। 
ভারতেশ্বরী হোমস-এ অধ্যয়নরত এবং পারিবারিকভাবে আর্থিক সঙ্কটাপন্ন এইরকম ছাত্রীর সংখ্যা আমার সঠিক জানা নাই, তবে জানি, সেটা নেহায়েত কম নয়। আবার বাইরে আমরা এখন যত সংখ্যক প্রাক্তন ছাত্রী আছি, সেই তুলনায় সেটা তেমন কিছু বেশিও নয়। উল্লেখযোগ্য তথ্য যে আমাদের আমলের মতবৈদেশিক স্পন্সরশিপের সুবিধাদি বহাল নাই আর। হাল আমলে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন স্থানীয় কিছু ব্যাক্তিএকক উদ্যোগে অল্প কিছু ছাত্রীকে স্পন্সর করছেন। অতএব,এই দায়িত্বটা যতদূর সম্ভব আমাদের কাঁধেওনিয়ে নিলে, আমাদের এই বিশাল পরিবারেরসহোদরাসম কিংবা সন্তানতুল্য কিছু শিশুর শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারটি সুরক্ষিত হয়।

প্রাথমিকভাবে, কয়েকজন বন্ধু মিলে দলীয়ভাবে অথবা ব্যাক্তি-উদ্যোগেও কাজটা শুরু করে দিতে পারি। হোমস-এ আছেন আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক মিস হেনা সুলতানা। এই বিষয়ে তাঁর পরামর্শ আর দিকনির্দেশনার দুয়ার সবসময় খোলা। আর যারা এই উদ্যোগে ইতোমধ্যেই সামিল হয়েছেন, তাদের সাথেও প্রয়োজনে কথা বলা যেতে পারে।
সবার জ্ঞ্যাতার্থে উল্লেখ করছি,২০১৭ সাল থেকে প্রতি শিক্ষার্থীর মাসিক বেতন হচ্ছে ৩,৫০০ টাকা। কথার কথা, সাতজন বা দশজনের একটা দলওঅনায়াসে একজন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে পারেন। তবে, ব্যাচ ধ’রে কাজটা করতে পারলে হয়তো ভাল হয়। একক দায়িত্ব-ও নিতে পারেন আপনি। যেমনই হোক, আপনার উদ্যোগের স্থায়িত্বের অঙ্গীকারটুকুও অবশ্য জরুরি। 

আমরা যদি সবাই মিলে এই কাজটায় মনোনিবেশ করি, অদূর ভবিষ্যতে আমরাইহয়ে উঠতে পারি আমাদের ভারতেশ্বরী হোমস-এর আর্থিক সঙ্কটাপন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য  নিয়মিত স্পন্সরশিপের একটা উৎস। সংগঠিত হয়ে ওদের জন্য তৈরি করতে পারি নিরাপদ আর নির্ভরযোগ্য একটা ‘স্পন্সরশিপ সিস্টেম’।

ফোন কোম্পানি আর ইন্টারনেটের বদৌলতে, যোগাযোগ এখন হাতের মুঠোয়। এই সুযোগের সদ্ব্যবহারে, জিইয়ে রাখি আমাদের উদ্যম। স্পষ্ট করি আমাদের উদ্যোগ। আর আমাদের ভালবাসায় ভাল হোক ভারতেশ্বরী হোমস-এর সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন।

এবারের পুনর্মিলনী হোক এই প্রণোদনার অদম্য সূচনা।

আলোহা!
সারিয়া মাহিমা
এসএসসি – ১৯৯৪
৯ ডিসেম্বর, ১৯১৬

পুনঃপুনশ্চঃলেখাটি শেষ করে, সদ্য জানতে পারলাম, জয়াদি’ আরনেই।আজ শেষ-অপরাহ্নে চির বিদায় নিলেন।মহাজাগতিক সফরে তাঁর আত্মার শান্তিপূর্ণ যাত্রা হোক।

One Thought to “পুনর্মিলনী পুনশ্চ”

  1. Saria Nafia

    অসাধারণ এই লেখাটা। এতো স্পষ্ট, এতো জোড়ালো!

Leave a Reply to Saria Nafia Cancel reply